নিজস্ব প্রতিবেদক: সেতু কিংবা উড়ালসড়কের খুঁটি আর উড়ালপথের সংযোগে বসানো হয় বিয়ারিং। যানবাহন কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট ঝাঁকুনি থেকে সুরক্ষা ও অবকাঠামো টেকসই রাখাই বিয়ারিংয়ের প্রধান কাজ। যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুতে এ ধরনের বিয়ারিং রয়েছে ১১২টি। সেতুর অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্সের (ওঅ্যান্ডএম) দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ৪৫ শতাংশ বিয়ারিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে
ক্ষতিগ্রস্ত এসব বিয়ারিং প্রতিস্থাপনের পরামর্শও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৯৪ সালের অক্টোবরে শুরু হয়ে ১৯৯৮ সালের জুনে শেষ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণকাজ। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশনের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু নির্মাণ করে। নির্মাণের সময় সেতুতে যেসব বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়, সেগুলো সরবরাহ করেছিল ইতালির প্রতিষ্ঠান এফআইপি ইন্টারন্যাশনাল। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ব্যবহার হওয়া বিয়ারিংগুলোকে প্রকৌশলীদের ভাষায় বলা হয় ‘পট বিয়ারিং’। দুটি বৃত্তাকার ইস্পাতের পাতের মাঝখানে বিশেষ ধরনের রাবার দিয়ে তৈরি হয় এ ধরনের বিয়ারিং।
সেতুর মতো অবকাঠামোতে বিয়ারিং কেন প্রয়োজন হয়, জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, বড় সেতু কিংবা ফ্লাইওভারে ব্যবহূত হয় বিয়ারিং প্যাড। পিলারের সঙ্গে ওপরের কাঠামো জোড়া দেয়ার সংযোগস্থলে বসানো হয় এটি। বিয়ারিং প্যাড অনেকটা কুশন বা বালিশের মতো কাজ করে। সেতু বা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যখন কোনো গাড়ি চলে, তখন চাপ সরাসরি পিলারে না এসে বিয়ারিং প্যাডে পড়ে এবং ভার পুরো পিলারের ওপর ছড়িয়ে দেয়। ফলে ব্রিজ কিংবা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচলের সময় কোনো ধরনের ঝাঁকুনি হয় না বা হলেও কম হয়। ঝাঁকুনি প্রতিরোধের পাশাপাশি সেতু বা ফ্লাইওভারকে টেকসই করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিয়ারিং প্যাড। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে সেতু বা ফ্লাইওভারের অবকাঠামোর যে ক্ষয় হয়, তা প্রতিরোধ করে এ বিয়ারিং।
নির্দিষ্ট সময় পর বিয়ারিং বদলানোর নিয়ম রয়েছে উল্লেখ করে ড. সামছুল হক বলেন, বিয়ারিং প্যাডের একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। মেয়াদ শেষ হলে সেটি বদলে নতুন প্যাড বসাতে হয়। কিন্তু আমাদের এখানে এ চর্চা নেই বললেই চলে। সময়মতো বিয়ারিংগুলো প্রতিস্থাপন না করলে তাতে সেতুর কাঠামো ও পিলারে বড় ধরনের ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।
বঙ্গবন্ধু সেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে ম্যানুয়াল তৈরি করা হয়েছে, তাতে বিয়ারিং প্যাডগুলোর জীবনকাল নির্ধারণ করা আছে ২০ থেকে ৩০ বছর। সেতু চালু হয়েছে ২৩ বছর আগে। এ সময়ে বিয়ারিং প্যাডগুলোও বদলানো হয়নি। অর্থাৎ সেতুতে ব্যবহূত বিয়ারিং প্যাডগুলো মেয়াদোত্তীর্ণের পথে।
সেতুর ওঅ্যান্ডএম প্রতিষ্ঠান সিসিসিসির এক প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে এ প্রতিবেদন দাখিল করেছে সংস্থাটি। এতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সেতুতে স্থাপিত ১১২টি বিয়ারিংয়ের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশের ‘পিটিএফই প্যাড’-এ সমস্যা দেখা গেছে। এজন্য বিয়ারিংগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিস্থাপনের পরামর্শও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বিদ্যমান বিয়ারিংগুলো কেনা হয়েছে ইতালির একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। জীবনকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় প্যাডগুলো বদলে ফেলার সময় হয়ে এসেছে। এজন্য ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করে বিয়ারিং প্যাড আনা ও সেগুলো সেতুতে স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। তার আগে বঙ্গবন্ধু সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ম্যানুয়াল অনুসরণ করে পট বিয়ারিংয়ের স্পেসিফিকেশন ও প্রাক্কলন প্রস্তুত করতে হবে।
সম্প্রতি সেতু বিভাগে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গবন্ধু সেতু পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত পর্যালোচনা সভা’তেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেতুর বিয়ারিংগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউসকে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর বিয়ারিংগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী বণিক বার্তাকে বলেন, মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলেও এ ধরনের সমস্যা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত বিয়ারিংগুলো এখন পর্যন্ত সেতুর কাঠামোর জন্য কোনো হুমকি তৈরি করছে না। একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিয়ারিংগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল। সেই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই বিয়ারিং এনে সেতুতে প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এজন্য কিছুদিন সময় প্রয়োজন।
বিয়ারিংগুলো প্রতিস্থাপনের সময় বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, স্থাপন কাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। তাই কাজ চলাকালে সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না।