মোঃ সাইফুল ইসলাম
মানুষের বিকাশিত হবার সাথে সাথে তার মধ্যে ব্যক্তি সাতন্ত্রবোধ জেগে ওঠে। পশু পূঁজ্য হয়ে গেল গৌন যখন পশু হলো মানুষের অধীন। মানুষ যখন বুঝতে পারলো বন্য জন্তুকে বশ করে পোষ মানানো যায়। তখন থেকেই নিজের মধ্যে সতন্ত্রবোধের জন্ম হলো। তখন থেকে নিজেকে ভাবলো নিজেকে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর। প্রথমতঃ বন্য পশুদের বশ করেছে নারী, পোষ মানিয়েছে নারী। কিন্তু দর্শনার্থী পুরুষ যখন ভাবলো যা প্রকৃতির মধ্যে তাকে বশ করা ও পোষ মানানো যায়। সে আরও ভাবতে থাকলো ক্ষমতার উৎস গুলো কি? ক্ষমতার উৎস খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেল শক্তি ও কৌশলকে। শক্তির উৎস খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেল হাতিয়ারকে। যা দ্বারা নিজেকে রক্ষা করা এবং অপর পক্ষকে (হিংসার জন্তু) বধ করা যায়। আর কৌশলের উৎস খুঁজতে গিয়ে সে খুঁজে পেল- স্থান, সময় ও অবস্থাকে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা ক্ষমতার উৎস গুলো তার অবদমন মনে লুকিয়ে রাখলো শত সহস্র বছর। এরই মধ্যে পুরুষরা আবিষ্কার করলো কেন তারা নারীর অধীন। আর অধীনতার “কারন” খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেল নারী পুরুষের চেয়ে ক্ষমতাধর। হাতিয়ার তার হাতে, কৌশল তার হাতে, সিদ্ধান্ত তার হাতে, বন্টন তার হাতে, গোত্র (সংঘবদ্ধ সমাজ) তার হাতে। এতেই নারী হয়েছে পুঁজনীয় ও সম্মানীয়। পুরুষ দীর্ঘদিন অবদমিত মনে লুকিয়ে রাখা, নারী ক্ষমতাকে মেনে নিতে না পেরে কৌশল (স্থান, সময়, অবস্থা) প্রয়োগে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। স্থানকে খুঁজে পেল নারীকে গর্ভবতী করা, অবস্থাকে ব্যবহার করলো নারীকে বিশ্রামে রাখা, আর সময়কে পেল হাতিয়ার হাতিয়ে (কেড়ে) নেবার। কৌশল সফল হলো পুরুষ, হাতিয়ার চলে গেল পুরুষের হাতে। শুধু বন্টন থাকলো নারীর হাতে (সুষম বন্টন)। সময়ের আবর্তনে এক পর্যায় বন্টন ব্যবস্থা চলে গেলো পুরুষের হাতে। গন্ডীবদ্ধ হলো নারী, সীমিত হতে থাকলো তাদের কাজ। শিকারী প্রধান হলো পুরুষ। হাতিয়ার এখন পুরুষের হাতে। নারীর হাত থেকে পর্যায়ক্রমে সকল ব্যবস্থা চলে গেল পুরুষের হাতে। পুরুষ হলো পরিবার প্রধান, গোত্র প্রধান এবং সমাজ প্রধান। নারী ও পুরুষের মধ্যে রক্তপাতহীন এক বিপ্লব ঘটে গেল পৃথিবীর বুকে।
মানব সমাজের নারী পুরুষের মধ্যে নারী পরাজিত হলো। নারী সমাজ এবং মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নিল পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার। নারীর কাজ হয়ে গেল সীমিত। বাচ্চা লালন পালন ও পশু লালন পালন করা। আর মৃৎ বাসন কোসন তৈরী করা হলো গৃহজীবি নারীর কাজ। নারীরা গৃহে বন্দী না থেকে কৃষিকাজ শুরু করে। তখনকার চাষ পদ্ধতি ছিল বর্তমান “জুম” অর্থ্যাৎ গুচ্ছ ফলাদি চাষ। প্রতিটি আবিষ্কারের মুলহোতা ছিলেন নারী। কিন্তু সেই আবিষ্কার যখন সম্পদে পরিনত হয়, তখনই তা নারীর হাত থেকে পুরুষ কৌশলে ছিনিয়ে নিয়েছে। নারীর ক্ষমতাকে আর কোন ভাবেই এগুতে দেয়নি পুরুষরা। নারীকে হাতিয়ার শুন্য, ভূমিশুন্য আর সম্পদহীন করে পুরুষ হয় সম্পদ ও গোত্রের একক অধিপতি। আবার পুরুষ গোত্রের হাত থেকে যখন সম্পদ ও ভূ-সম্পত্তি চলে যায় ব্যক্তি পুরুষের হাতে। তখনই তৈরী হয় সামাজিক শ্রেণী বিভাজন। এক পক্ষ পুরুষ হয় সম্পদশালী অপর পক্ষ পুরুষ ও নারী হয় সম্পদহীন। জোট বাঁধা পরিবার বা বহু দম্পতি পরিবার ভেঙ্গে গড়ে ওঠে একক দম্পতি পরিবার। এরপর শুরু হয় সম্পত্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়া। একক পরিবারই নির্ধারন করে উত্তারধিকার। উত্তারাধিকার পর্ব থেকে এবং সমাজে তৈরী হলো বিভাজন। ব্যাক্তিগত মালিকানা থেকে পরিবার ও সমাজে তৈরী হলো বিভাজন। সমাজে কেউ হলো কর্তা বা প্রভূ। আর কেউ হলো অধিনস্ত বা দাস। দাস হলো প্রভূর অধীন। প্রভূরা হলেন উৎপাদক শ্রেনী আর দাসরা হলেন অন উৎপাদক শ্রেনী। সম্পদহীন নারী সমাজে হলেন অনউৎপাদক শ্রেনীর অন্তর্ভূক্ত। নারীকে সমাজের প্রতিটি কাজ থেকে বহিষ্কার করে তাকে করা হলো সর্বহারা। শ্রেনী বিভাজনে নারী হলেন- গৃহবন্দী। কেউ বা গৃহে আর কেউ মহলে বন্দী। মহল বন্দী নারী খেতাব পেলেন “মহিলা”। পুরুষকে রমন করার জন্য হলেন “রমনী” এবং পুরুষের দাসী, ভোগ্যা ও উত্তরাধিকার উৎপাদনের যন্ত্র বিশেষ। ক্ষমতার সৃষ্টি হয় না এর শুধু হাত বদল হয় মাত্র। রক্তপাতহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতা পুরুষের হাতে চলে যায়। এভাবেই নারী জাতির মাতৃতন্ত্রের পরাজয় ঘটে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার (উৎপাদন, ভোগ ও বন্টন অর্থ্যাৎ সুষম বন্টন) চরম অবনতি ও পরাজয় ঘটে। আর মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই হলো আদি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা। ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞানীগন আদি সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়াকেই এবং অধিনস্থতাকেই নারীর ঐতিহাসিক পরাজয় হিসেবে অভিহিত করেন।
মানুষ প্রজাতির অপর পরাজিত লিঙ্গের সামাজিক নাম “নারী”। যদিও “নারী” মানুষ হয়েই জন্ম নেয় কিন্তু সমাজ তাকে “নারী” বানিয়া তোলে বিভিন্ন পুরুষ নিয়ন্ত্রিত প্রথার মধ্য দিয়ে। প্রথা শিখিয়ে দেয়। প্রত্যুষ থেখে রাত্রী; জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিজয়ী পুরুষ জাতীকে অভিবাদন জানাতে। হোক না সে নপুংসক পুরুষ, অভিবাদন করতেই হবে নারীকে। নিজের শরীর মন সবই বন্দী পুরুষের শিকলে। কারন প্রথা ও লোকবানী শিখিয়েছে পুরুষের দেহ অঙ্গ থেকেই নারীর জন্ম (ভ্রান্ত তথ্য বিজ্ঞান বলে)। আজকের পৃথিবীর সভ্য সমাজের (কথিত) দাবীদার পুরুষ। পরাজিত অপর লিঙ্গ “নারী”, দাসত্বের শিকলে বন্দী। দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তি পেতে হলে নারীকেই আত্ম সচেতন মননশীল “মানুষ” হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে। নারীকেই সংগঠিত করতে হবে সামাজিক বিপ্লব। যতদিন না আত্মবিশ্বাসী নারীগন বা নারী জাতি এই বিপ্লব বা পরিবর্তন সংঘঠিত করতে না পারবে ততোদিন নারী থাকবে পুরুষের অধীন। আর নারী সংসারে থাকবে দাসী, শয্যায় হবে রমনকারী, ভোগ্যা, চিন্তায় হবে পুনঃ উৎপাদনকারী যন্ত্র। বর্তমান সমাজ সভ্যতায় নারী পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য চলমান তার অবসান হওয়া প্রয়োজন। মননশীল পুরুষ ও নারী সম চেতনায় জেগে না উঠলে ঘুচবে না নারী ও নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয় এবং নারী পুরুষের সামাজিক বৈষম্য এবং মিলবে না নারী মুক্তি।